কাফিরদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান সংক্রান্ত শারীয়াহর মূলনীতি -১

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

নিশ্চয়ই সব প্রসংশা আল্লাহর। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ উপর এবং তার ﷺ পরিবারের উপর এবং তার ﷺ সাহাবীগণের উপর।

‘আম্মা বা’আদ

এই প্রবন্ধটির রচনার উদ্দেশ্য কাফিরদের জান, মাল ও সম্মানের ব্যাপারে শারীয়াহর মূলনীতি (আসল) স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা। শারীয়াহর আলোকে কোন কোন ক্ষেত্রে কাফিরদের জান, মাল ও সম্মান সংরক্ষিত বলে বিবেচিত হয় তা বর্ণনা করা। বর্তমান সময়ে এরকম একটি প্রবন্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে, কারন সার্বিক ভাবে এ বিষয়ে সাধারনের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ভুল ধারনা প্রচলিত আছে, এবং বিশেষ ভাবে অধিকাংশ মুসলিম এ বিষয়ে শারীয়াহর অবস্থান কি তা সম্পর্কে অজ্ঞ। কাফির প্রাচ্যবিদদের (Orientalist) সহায়তায় পরাজিত মানসিকতার কিছু মুসলিমদের একটি আন্দোলন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গড়ে উঠেছে যার উদ্দেশ্য হল “আধুনিকতা” ও পশ্চিমাদের দ্বারা সংজ্ঞায়িত “মধ্যমপন্থা”-র (Moderateness) মাপকাঠি অনুযায়ী দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়াদী ও বিধিবিধানকে পুনঃনির্ধারণ করার। যদিও শারীয়াহর আলোকে অত্যন্ত সহজেই এধরনের ভ্রান্ত ধারণাসমূহের খন্ডন ও অপনোদন করা যায়, তথাপি উম্মাহর বর্তমান অজ্ঞতা এবং ঔদাসীন্যের কারনে শত্রুর এ চক্রান্ত প্রসার লাভ করেছে।

কাফিরদের সহযোগী এসব পরাজিত মানসিকতার এবং হীনমন্যতায় ভোগা মুসলিমরাই নিজেরদের স্লোগান হিসেবে “ইসলাম মানে শান্তি”, “জিহাদ শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য”, “গণতন্ত্র ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ”- ইত্যাদিকে মেনে নিয়েছে। এবং দ্বীনের মৌলিক বিষয়াবলীকে পুনঃনির্ধারনের জন্য তাদের এ চেষ্টা তাদের স্লোগানগুলোর মতোই ভিত্তিহীন, শার’ঈ দলিল বিবর্জিত এবং দ্বীন ইসলামের মৌলনীতিসমূহের সাথে সাংঘর্ষিক। সুউচ্চ মহিমাময় আল্লাহ তা’আলা শত্রুদের এই সব চক্রান্ত উন্মোচিত করেছেন এবং যারা দ্বীন সম্পর্কে আন্তরিকভাবে ও সঠিকভাবে জানতে চান সেসব মুসলিমদের জন্য এসব প্রতারণার বাস্তব রূপ অনুধাবন করাকে সহজ করেছেন।

হে মুসলিমগণ, আপনারা নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে শত্রুকে খুশি করার সচেষ্ট হবেন না। পরাজিত মানসিকতার ও  হীনমন্যতায় ভোগা ব্যাক্তিদের প্রয়োজন ইসলামের নেই। ইসলামই একমাত্র সত্য এবং কুফর মাত্রই মিথ্যা, কাফিররা যাই মনে করুক না কেন। এবং কাফিরদের চক্রান্ত এবং পরিকল্পনা যতই প্রবল হোক না কেন আল্লাহর দ্বীন দ্বারাই দুনিয়া শাসিত হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন –

يُرِيدُونَ أَن يُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللَّهُ إِلَّا أَن يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ [٩:٣٢]

তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপ্রীতিকর মনে করে। [1]

এ প্রবন্ধের ক্ষেত্রে আমরা সাধ্যমত ‘ইলমের কিতাবসমূহ অনুসন্ধান করেছি, এবং যথাসম্ভব বিস্তারিত ভাবে রেফারেন্স উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি যাতে করে আগ্রহী পাঠক আমাদের অনুবাদ ও উদ্ধৃতি নিজেরা যাচাই করে নিতে পারেন। যখনই সম্ভব হয়েছে আমরা আমরা যেসব কিতাব সমূহকে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেগুলোর প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্যবলীও দেয়ার চেষ্টা করেছি যাতে করে পাঠকের জন্য যাচাই করার কাজটি সহজ হয়। আহলুল ‘ইলমের যেসব বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে সেগুলো গ্রহন করা হয়েছে বিশেষভাবে বিভিন্ন মাযহাবের ফিকহবিদদের ফিকহ বিষয়ক রচনাবলী ও অন্যান্য রচনাবলী থেকে। একারনে আলোচনায় এমন অনেক বিষয় উঠে এসেছে যেগুলো সুক্ষ আলোচনার দাবি রাখলেও আমরা সেগুলোর বিস্তারিত ব্যাখায় যায় নি। কারন এ প্রবন্ধে আমাদের উদ্দেশ্য কাফিরদের জান, মাল ও সম্মানের ব্যাপারে শারীয়াহর মূলনীতির ব্যাপারে উম্মাহর ফিকহবিদ, উলামা এবং মুহাদ্দিসগনের কি অবস্থান ছিল তা পাঠকের কাছে তুলে ধরা।

সালাম এবং দুরুদ বর্ষিত হোক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ উপর, তাঁর ﷺ পরিবারের উপর এবং তাঁর ﷺ সাহাবীদের উপর শেষ বিচার দিন পর্যন্ত।

অধ্যায় ১

কাফিরদের রক্ত, সম্পদ এবং সম্মান সংক্রান্ত মৌলিক নীতির (আসল) ব্যাপারে শারীয়াহ থেকে দলিলঃ

শারীয়াহর দালীলের আলোকে দেখা যায়, (শারীয়াহর) মৌলিক নীতি (আসল) হল কাফিরদের রক্ত এবং সম্পদ হালাল। এর দলিল সমূহ হলঃ

আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

ْ فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُم

“কিন্তু যদি তারা তওবা করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও” [2]

এবং আল্লাহ মহিমাময় বলেছেন,

فَإِن تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ

“অবশ্য তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে আর যাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই।” [3]

এবং এ হাদিসঃ

নু’আইম (র)……আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ আমাকে লোকের বিরুদ্ধে জিহাদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না তারা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’’ উচ্চারন করবে। যদি তারা তা উচ্চারন করে, তবে তাদের জান-মাল সমূহ আমার কাছ থেকে সুরক্ষা পাবে। অবশ্য রক্তের বা সম্পদের ব্যাপারে দাবীর কথা ভিন্ন। আর সেগুলোর হিসাব আল্লাহর কাছে। [4]

এবং এ হাদিসঃ

আমর ইবন ‘আব্বাস (র)…… আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের ন্যায় সালাত আদায় করে, আমাদের কিবলামুখী হয় আর আমাদের যবেহ করা প্রাণী খায়, সে-ই মুসলিম, যার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যিম্মাদার*। সুতরাং তোমরা আল্লাহর যিম্মাদারীতে খিয়ানত করো না। [5] [ “যার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যিম্মাদার” অর্থাৎ সে আল্লাহ ও তার পক্ষ থেকে সুরক্ষা প্রাপ্ত]

এবং এ হাদিসঃ

মুহাম্মদ ইবন মুছান্না (র)……মায়মুন ইবন সিয়াহ হুমায়দ (র) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, আনাস ইবন মালিক (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করেনঃ হে আবু হামযা ! কোন সে বিষয় যা বান্দার রক্ত ও সম্পদ হারাম করে?* তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি এ কথার সাক্ষ্য দান করে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল, এবং আমাদের কিবলার দিকে মুখ করে, আর আমাদের ন্যায় নামায পড়ে, আমাদের যবেহকৃত পশু ভক্ষণ করে, তবে সে মুসলমান । মুসলমানদের যে হক তারও সেই হক, আর তার উপর ঐ সকল দায়িত্ব বর্তাবে যা মুসলমানদের উপর বর্তায়। [6] [“কোন সে বিষয় যা বান্দার রক্ত ও সম্পদ হারাম করে?*” – অর্থাৎ একজন ব্যক্তির মাঝে কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে তার জান ও মাল শারীয়াহ অনুযায়ী সুরক্ষিত হবে? ]

এবং হাদিসটি,

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা পরস্পরের প্রতি হিংসা পোষণ করো না, নকল ক্রেতা সেজে আসল ক্রেতার সামনে পণ্যের দাম বাড়িও না, ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না, একজনের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর অন্যজন ক্রয়-বিক্রয় করো না। আল্লাহর বান্দাগণ! ‘তোমরা ভাই ভাই হয়ে থাকো। জেনে রাখো, মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তাকে না জুলুম করতে পারে, না হীন জ্ঞান করতে পারে অথবা না পারে অপমান অপদস্ত করতে। তাকওয়া এখানেই থাকে। (এ কথাটা তিনি তিনবার বলেন এবং তিনি নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন) কোন ব্যক্তির খারাপ প্রমাণিত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে ঘৃণা করে কিংবা হীন জ্ঞান করে। বস্তুত প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত (জীবন), ধন-মাল এবং মান-ইজ্জত অন্য মুসলমানের জন্য হারাম। [7]

মুসলিম শরীফে উক্ত হাদিসটি “হত্যা, সম্মান এবং মালের হক বিনষ্ট করা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি” –অধ্যায়ের অধীনে আনা হয়েছে এবং ইবনে মাজাহ (রঃ) “মুমিন ব্যাক্তির জান-মালের নিরাপত্তা” –অধ্যায়ের অধীনে এ হাদিসটি উদ্ধৃত করেছেন। ( বিঃদ্রঃ ইমাম মুসলিম তার সহিহ গ্রন্থে অধ্যায় নাম করেননি করেছেন ইমাম নাওয়াউয়ি)

এবং আবূ সাঈদ আল-খুদরী থেকে বর্ণিত – তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বিদায় হজ্জে বলেছেনঃ সাবধান! তোমাদের এই দিন সর্বাপেক্ষা সম্মানিত দিন। সাবধান তোমাদের এই মাস সর্বাপেক্ষা সম্মানিত মাস। সাবধান! তোমাদের এই শহর সর্বাপেক্ষা সম্মানিত শহর। সাবধান! তোমাদের জীবন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের ইজ্জত-আব্রু তোমাদের পরস্পরের জন্য তো পবিত্র, যেমন এই দিন, এই মাস ও এই শহর। শোন! আমি কি (আল্লাহর পয়গাম) পৌঁছে দিয়েছি? সমবেত জনমন্ডলী বলেন, হাঁ। তিনি বলেনঃ হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। [8]

সুতরাং উপরোক্ত দালীলের আলোকে আমরা বুঝতে পারি শারীয়াহর অবস্থান হল, যে মূহুর্তে একজন ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করে ঐ মূহুর্ত থেকে তার রক্ত ও সম্পদ শারীয়াহ দ্বারা সুরক্ষিত বলে বিবেচিত হবে। এ থেকে আরো বোঝা যায়, আবশ্যক ভাবেই তাহলে ইসলামের প্রবেশের পূর্বে ঐ ব্যক্তির রক্ত ও সম্পদ শারীয়াহ দ্বারা সুরক্ষিত ছিল না। অর্থাৎ তা হালাল ছিল। কারন যদি ইসলামের প্রবেশের পূর্বেই ব্যক্তির রক্ত ও সম্পদ সংরক্ষিত বা হারাম হয়ে থাকে, তাহলে আলাদাভাবে উপরোক্ত আয়াত ও হাদিসসমূহে ইসলামে প্রবেশের পরই ব্যক্তির রক্ত ও সম্পদ সংরক্ষিত বা হারাম হবার উল্লেখ থাকা অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। দুটি শারীয়াহতে উভয় শ্রেণীর যদি একই মর্যাদা থাকত তাহলে একটি শ্রেণীকে (কাফির) রেখে শুধুমাত্র একটি শ্রেণীকে (মুসলিম) নির্দিষ্ট করা এক্ষেত্রে যৌক্তিক হতনা। যদি তাই হত তাহলে “মানুষের জন্য অপর মানুষের জান, মাল এবং সম্মান সবকিছু হারাম” এমন শব্দেই এ হুকুম বর্ণিত হত। সুতরাং পরিশেষে বলা যায়, মুসলিমদের জান, মাল ও সম্পদকে শারীয়াহতে যে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, কাফিরদের জান, মাল ও সম্পদকে সে সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। মুসলিমদের জান, মাল ও সম্পদকে শারীয়াহতে হারাম করা হলেও, কাফির জান, মাল ও সম্পদকে হারাম করা হয়নি। যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে কাফিরদের জান, মাল ও সম্পদের ব্যাপারে মৌলিক নীতি (আসল) হল, এগুলো বৈধ (হালাল)।

উসুল আল-ফিকহের ভাষায় এধরনের মূলনীতিকে বলা হয় “মাফহুম আল মুওয়াফাকাহ” (the understanding of compliance) এবং “মাফহুম আল মুখালাফাহ” বলা হয় (the understanding of the opposite)।

মাফহুম আল মুওয়াফাকাহ এবং মাফহুম আল মুখালাফাহ নিয়ম দুটির ব্যাখ্যা

মাফহুম আল মুওয়াফাক্বাহঃ আল্লাহ তালা বলেন,

إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا

তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা। [9]

সুতরাং, পিতামাতার প্রতি যদি “উহ” বলাও নিষিদ্ধ হয় তাহলে অবশ্যই তাদেরকে প্রহার করা আরও গুরুতর ভাবে নিষিদ্ধ। যদিও আলোচ্য আয়াতে নির্দিষ্ট করে অধিকতর গুরুতর অপরাধের (পিতামাতাকে প্রহার করা) কথা উল্লেখ করা হয় নি, তথাপি এ অর্থটি প্রকাশ পায়। কারন “সরাসরি নুসুসের মাধ্যমে যা হারাম করা হয়েছে, তার সমপর্যায়ের বা তার চেয়ে অধিক পর্যায়ের যা আছে সে কাজ বা বস্তুকেও হারাম করা হয়েছে। অতএব সরাসরি যা হারাম করা হয়েছে তার চেয়ে যা গুরুতর পর্যায়ের তা আরো অধিক ভাবে হারাম গন্য হবে।” এ নিয়মটিকেই বলা হয় “মাফহুম আল মুওয়াফাক্বাহ”।

মাফহুম আল মুখালাফাহঃ আল্লাহ তালা বলেন,

وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰ أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَدًا وَلَا تَقُمْ عَلَىٰ قَبْرِهِ

আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও (জানাযা) সালাত পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না।[10]

সুতরাং বলা যায়, অবিশ্বাসী মুনাফিক হল তারা যাদের জানাযার নামায পড়া এবং তাদের কবর যিয়ারত করা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নিষিদ্ধ করেছেন। সুতরাং এ থেকে আবশ্যক ভাবে বোঝা যায়, মুসলিম হল তারাই যাদের মৃত্যুর পর অপর মুসলিমরা তাদের জানাযার নামায পড়ে এবং তাদের কবর যিয়ারত করে। এ নিয়মকেই মাফহুম আল মুখালাফাহ বলা হয়। কারণ কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আমরা যদি বলি, কাফির হল তারা যাদের জন্য আল্লাহ এ বিষয়টি হারাম করেছেন, তবে আবশ্যক ভাবেই ঐ নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যারা কাফিরদের বিপরীত (অর্থাৎ মুসলিম) তাদের জন্য হুকুম হবে এটিই মাফহুম আল মুখালাফাহ নিয়মের ব্যাখ্যা। একে দালিল “আল খিতাব”-ও বলা হয়। [11]

কোন শার’ঈ দালীলে শব্দাবলীর ব্যবহার থেকে কিভাবে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ পায়, এ আলোচনায় শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, “…কিংবা এমন হতে পারে যে কাজ বা বস্তুর বা শ্রেণীর ব্যাপারে হুকুম বর্নিত হয়েছে তা শুধুমাত্র ঐ বিষয়টির জন্যই নির্দিষ্ট। এবং (যে কাজ, বা বস্তু বা শ্রেণী) ভিন্ন অপর সকল ক্ষেত্রে ঐ হুকুম প্রযোজ্য হবে না। যেমনটা “আমহফুম আল মুখালাফাহ’-র ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, যদি সাধারন ভাবে সকলের জন্য প্রযোজ্য একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীকে উল্লেখ করা হয়। [12]

তিনি আরও বলেন, “এবং ফকিহগণ বর্ণিত এবং অবর্ণিত বিষয়ের মাধ্যমে ইঙ্গিত সম্পর্কে বলেছেন- তা হল (বর্ণিত ও অবর্ণিত বিষয়াদি) বিধানদাতা তাঁর ক্বুর’আনে ও তাঁর রাসূলের ﷺ মাধ্যমে যা উল্লেখ করেছেন এবং যা উল্লেখ করেন নি। কোন সময় যা অবর্ণিত তা বর্ণিত অপেক্ষা হুকুম আহরনের ক্ষেত্রে বিশ্লেষনে অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। এবং এটিই মাফহুম আল মুওাফাকাহ এবং কিছু সময় যা উল্লেখিত হয়েছে তার বিপরীত হুকুম আহরণের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণে অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য, এবং একে বলা হয় মাফহুম আল মুখালাফাহ হয়। এবং অনেক ক্ষেত্রে বর্ণনার অনুরুপ সাদৃশ্যতার ভিত্তি হুকুম আহরন করা হয়, যা হল ক্বিয়াস”।[13]

কাফিদের জানাজ পড়া হারাম হওয়ার হুকুম থেকে মুসলিমদের জানাযা পড়া এবং করব যিয়ারতের বৈধতার হুকুম পাবার উদাহরণটি শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বারবার ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন- “আর তাদের মধ্য থেকে কারো মৃত্যু হলে তার উপর কখনও নামায পড়বেন না এবং তার কবরে দাঁড়াবেন না।“ অতএব এ আয়াতে “দলিল আল খিতাব” হল মুসলিমদের জানাজা পড়া যাবে এবং তাদের কবর যিয়ারত করা যাবে। [14]

মুসলিম নারীর জন্য নিক্বাব ও হাতমোজা পড়া বাধ্যতামূলক হবার দালীলের আলোচনায়, “এবং ইহরাম পরিহিতার নিকাব এবং হাতমোজা পড়া উচিত নয়” [15]– এ হাদিসের আলোচনায় শায়খ আব্দুল ক্বাদীর ইবন আবদুল আযীয বলেন, “এ হাদিস থেকে মাফহুম আল-মুখাফালাহর মাধ্যমে বোঝা যায় ইহরাম পরিহিতা ছাড়া অন্যান্য নারীদের নিক্বাব এবং হাতমোজা পড়তে হবে”।[16]

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে “মাফহুম আল-মুওয়াফাক্বাহ” ও “মাফহুম আল-মুখালাফাহ”-র [17] নিয়মের ভিত্তিতে বলা যায় মুসলিমের রক্ত, সম্পদ সুরক্ষিত ও হারাম হওয়ার হুকুম থেকে বোঝা যায় যারা মুসলিমদের বিপরীত (অর্থাৎ কাফির) তাদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানের জন্য রয়েছে বিপরীত বিধান।

লক্ষ্য করুন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে লা ইলাহা ইল্লালাহ বলে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যসব মাবুদকে অবিশ্বাস করে তার সম্পদ এবং তার রক্ত হারাম (সংরক্ষিত)। আর তাদের হিসাব আল্লাহর কাছে। [18]

এখন লক্ষ্য করুন এ হাদিসের ব্যাখ্যায় শায়খ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওয়াহহাব রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য। তিনি বলেন – রাসূলুল্লাহর ﷺ এ হাদিসে “এবং আল্লাহ ব্যতিত অন্যসব মাবুদকে অবিশ্বাস করে”, কথাটির মাধ্যমে (আল্লাহ ব্যাতীত অন্য সকল মাবুদকে) প্রত্যাখ্যানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ ব্যাতীত অন্য সকল মাবুদকে অস্বীকার করা ব্যাতীত ব্যক্তির জান ও মাল হারাম (সংরক্ষিত হবে না)। সুতরাং ব্যক্তি যদি ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ বা দ্বিধা পোষণ করে তবে তার জান ও মাল সংরক্ষিত হবে না। [19]

এবং এ হল ইতিপূর্বে উল্লেখিত নিয়মের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।

কুফরের বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতির কারনেই কাফিরের রক্ত ও সম্পদ হালাল

উপরের দালীলগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই একজন মুসলিমের মধ্যে ইমানের বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকার কারনেই তার জান, মাল ও সম্পদ শার’ঈ ভাবে সংরক্ষিত বা হারাম। অর্থাৎ একজন মুসলিমের জান, মাল, সম্পদ হারাম, কারন সে ইমান এনেছে। এ বৈশিষ্ট্যই কাফির এবং মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করেছে। সুতরাং একজন কাফিরের মধ্যে কুফরের বৈশিষ্ট্য উপস্থিত থাকার কারনেই তার জান, মাল ও সম্পদ হালাল। কুফরের কারনেই জান ও মাল সংরক্ষিত বলে বিবেচিত হবে না। এবং এটি নুসুস এবং সাধারন বিচার বিবেচনা উভয়ের মাধ্যমেই জ্ঞাত। যা মাফহুম আল মুখালাফাহর আলোচনায় আমরা দেখেছি।

আক্রমণাত্মক এবং মুসলিম ও ইসলামের প্রতি আক্রমনাত্বক না, এমন দুই প্রকারের রিদ্দার আলোচনাতে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “যে নিছক রিদ্দা (ধর্মত্যাগ) করে তার উপর হত্যার হুকুম হবে শুধুমাত্র তার ধর্মত্যাগের অপরাধের কারনে। অতঃপর সে যদি দ্বীনে ফেরত আসে, তাহলে যে কারনে (অর্থাৎ তার রিদ্দা) তার রক্ত হালাল হয়ে গিয়েছিল তা অপসারিত হবে। ঠিক যেমনি ভাবে ইসলামে প্রবেশ করা মাত্র কাফির আসলির (যে শুরু থেকেই কাফির) রক্ত হালাল থেকে হারামে পরিণত হবে। [কারন ইসলাম গ্রহন করার দ্বারা, যে কারনে তার রক্ত ইতিপূর্বে হালাল ছিল – অর্থাৎ তার কুফর – তা অপসারিত হয়ে যাবে]। [20]

এবং “একজন মুসলিমকে কাফিরের বদলে হত্যা করা হবে না” [21] এ হাদিসের ব্যাপারে মতপার্থক্যের আলোচনায় ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন – যিম্মির রক্ত হালাল নয় এটি একটি সাধারণ ভুল ধারণা। কারণ যিম্মির রক্ত তার কুফরের কারনে হালাল। কিন্তু যিম্মি যে জিযিয়া প্রদান করে তা হল প্রতিরোধক চুক্তি (আহদ), যা তার হত্যাকে প্রতিরোধ করে। যদিও যে কারনে তার রক্ত হালাল, অর্থাৎ তার কুফর, তা তখনো বিদ্যমান থাকবে। [22]

অতএব আমরা দেখতে পাই যদিও কুফরের কারনেই কাফিরের জান মাল বৈধ [23]। কিছু বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা চুক্তি (আমান) আছে যার দ্বারা এ বৈশিষ্ট্য (অর্থাৎ কুফর) বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কাফিরদের জান ও মাল শার’ঈ ভাবে সুরক্ষিত হতে পারে।

[ইন শা আল্লাহ চলবে]

সূত্রঃ

ইংরেজী অনুবাদের লিঙ্কঃ http://www.islamicline.com/islamicbooks/new/current/Essay_Regarding_the_Basic_Asl_of_the_Blood,_Wealth_%20and_Honor_of_Kafireen-editable(www.islamicline.com).pdf

===========
রেফারেন্স

[1] [আত তাওবাহ, ৩২]

[2] [আত তাওবাহ, ৫]

[3] [আত তাওবাহ, ১১]

[4] [ইবন উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত]

[5] [বুখারী। *“যার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যিম্মাদার” অর্থাৎ সে আল্লাহ ও তার পক্ষ থেকে সুরক্ষা প্রাপ্ত]

[6] [সুনান নাসাই, ৩৯৬৮। “কোন সে বিষয় যা বান্দার রক্ত ও সম্পদ হারাম করে?*” – অর্থাৎ একজন ব্যক্তির মাঝে কোন কোন বৈশিষ্ট্য থাকলে তার জান ও মাল শারীয়াহ অনুযায়ী সুরক্ষিত হবে?]

[7] [সম্পূর্ণ বর্ণনাটি এসেছে মুসলিম শরীফে, এছাড়া তিরমীযি, আবু দাউদ ইবন মাজাহ, এবং মুসনাদ আহমদে সংক্ষিপ্তাকারে এসেছে। প্রতিটি বর্ণনাতেই এ লাইনটি এসেছে – “বস্তুত প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত (জীবন), ধন-মাল এবং মান-ইজ্জত অন্য মুসলমানের জন্য হারাম।” তবে শব্দের ক্রমবিন্যাসে, ব্যবহৃত শব্দের ক্ষেত্রে সামান্য পার্থক্য আছে।]

[8][ইবন মাজাহতে বর্নিত এবং শায়খ আলবানী ‘সাহীহ ইবন মাজাহ #,১৭৬-এ একে সাহীহ বলেছেন। “তোমাদের জীবন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের ইজ্জত-আব্রু তোমাদের পরস্পরের জন্য তো পবিত্র, যেমন এই দিন, এই মাস ও এই শহর।“ – অর্থাৎ মুসলিমের ধন-সম্পদ ও ইজ্জত-আব্রু অপর মুসলিমের জন্য হারাম। প্রত্যেকে মুসলিমদের ধন-সম্পদ ও ইজ্জত-আব্রু অন্য সকল মুসলিমদের পক্ষ থেকে সুরক্ষিত।]

[9] [আল ইসরাহ, ২৩]

[10] [আত তাওবাহ, ৮৪ ]

[11] [শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, অতএব এই হল ‘মাফহুম আল-মুখালাফাহ’, যাকে দালিল আল খিতাবও বলা হয় – মাজমু’ আল ফাতাওয়া, খন্ড ৩১/৩৪৫]

[12] [মাজমু’ আল-ফাতাওয়া, খন্ড ১৫/৪৪৬]

[13] [মাজমু’ আল ফাতাওয়া, খন্ড ৬/১৭৯]

[14] [মাজমু’ আল ফাতাওয়া, খন্ড ৩/৩৯৯; এবং খন্ড ২৪/৩৩০, ও খন্ড ২৭/৪৪৮]

[15][ বুখারীতে বর্ণিত]

[16][আল জামি ফি তালাব আল-‘ইলম আশ শারীফ, খন্ড ২/১,০৭০]

[17] [এ নিয়মদুটির আরো বিস্তারিত ব্যাখার জন্য পড়ুন, “ইরশাদ আল-ফুহুল” – আশ শাওকানী; পৃষ্ঠা ১৬৬ ২ ১৬৯; “মু’ওয়াসসাত আল-কুতুব আস-সাকাফিয়্যাহ” হতে প্রকাশিত; চতুর্থ সংস্করণ; ১৪১৪ হিজরি, এবং “আল-ইহকাম ফি উসুল আল-আহকাম” –ইবন হাযম; খন্ড ৭/৩৩৫-৩৬৫; “দ্বার আল-কুতুব আল-‘ইলমিয়্যাহ”; বৈরুত থেকে প্রকাশিত, এবং দেখুন “মুসাক্কিরাহ ফি উসুল-আল ফিকহ” – মুহাম্মাদ আল-আমিন আশ-শানক্বিতী; পৃষ্ঠা ২৮৩-২৯০; “মাকতাবাত আল-‘উলুমি ওয়াল-হিকাম”; আল মাদীনা আল মুনাওয়ারাহ থেকে প্রকাশিত; পঞ্চম সংস্করণ; ১৪২২ হিজরি, এবং “আল মুসতাফা ফি ‘ইলম আল-উসুল” – আবু হামিদ আল গাযযালি; পৃষ্ঠা ২৬৪-২৭৪; “দ্বার আল-কুতুব আল-‘ইলমিয়্যাহ”; বৈরুত থেকে প্রকাশিত, প্রথম সংস্করণ; ১৪১৩ হিজরি]

[18][মুসলিম]

[19] [দেখুন আদ-দুরুর আস সানিয়্যাহঃ “রিসালাত আসল দ্বীন আল ইসলাম”, আবদুর রাহমান ইবন হাসানের ব্যাখ্যা সহ]

[20] [আস-সরিমুল মাসলুল ‘আলা শাতিল আর-রাসূল, পৃষ্ঠা ৩৬৮-৩৬৯, “দ্বার আল-কুতুব আল-‘ইলমিয়্যাহ”, বৈরুত থেকে প্রকাশিত]

[21][বুখারীতে বর্ণিত]

[22] [“ফাতহ আল-বারি”, খন্ড ১২/৩২৬; “মাকতাবাত দ্বার আস-সালাম” ও “মাকতাবাত দ্বার আল ফাহইয়াহ” থেকে প্রকাশিত, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৮ হিজরি]

[23] [“…মুসলিমদের প্রতি তাদের বৈরীতার কারনে না। যদিও পরাজিত মানসিকতা ও হীনমন্যতায় ভোগা এবং পশ্চিমকে তোষনকারী “মডারেট” -রা এটা দাবি করে থাকে]

Leave a comment