করুণাময়ী মাদার টেরিজা
- ভূমিকা
- মাদার টেরিজার জীবন
- প্রথম পর্ব মাদারের জীবনের দ্বিতীয় পর্ব
- স্বীকৃতি ও পুরস্কার
- চরিত্র বৈশিষ্ট্য
- উপসংহার
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘নগরলক্ষ্মী’ কবিতায় বুদ্ধদেব শ্রাবন্তী পুরবাসীদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—
‘ক্ষুধিতেরে অন্নদান সেবা তােমরা লইবে বল কেবা”—কারণ ক্ষুধিত মানুষের হাহাকার বুদ্ধদেবের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। তাই তিনি শ্রাবন্তীপুরবাসীদের কাছে ক্ষুধার্ত মানুষকে অন্ন বিলােবার ভার কে নেবে তা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কিন্তু সমবেত শিষ্যদের মধ্যে উপস্থিত ধনাঢ্য ব্যক্তি থাকলেও বন্ধের আহানে কেউই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি। কিন্তু এগিয়ে এসেছিলেন অনাথ পিণ্ডদসূতা ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া| অনাথ পিণ্ডদসূতার মতাে মাদার টেরিজাও আপন জীবন পরহিত ব্রতে উৎসর্গ করেছিলেন। তার জীবন তিনি পরহিতায় পর সুখায়’ উৎসর্গ করেছিলেন।
মাদার টেরিজার জীবন—প্রথম পর্ব : মাদার টেরিজার জন্ম ১৯১০ সালে ২৬ আগস্ট যুগােশ্লোভিয়ার স্কুপিয়ে শহরে। বাল্য নাম ছিল অ্যাগনেস গােনশা বোজাশিউ। পিতা পেশায় চাষা এবং জাতিতে আলবানীয়। সাত বছর বয়সে বাবার মৃত্যু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের ব্যাপক হাহাকার মাদার টেরিজার মনকে আকৃষ্ট করে। স্কলে পড়ার সময়ই তিনি। সেবাধর্মে দীক্ষা নেন। ১৯২৮-এ সন্ন্যাসিনীর ব্রত গ্রহণ করে চলে আসেন দার্জিলিং শহরে। সেখান থেকে চলে আসেন কলকাতায়।
মাদারের জীবনের দ্বিতীয় পর্ব : কলকাতায় এসে মাদার এন্টালির সেন্ট মেরিজ হাই স্কুলে ভূগােল শিক্ষিকা হিসাবে যােগ দেন। পরে লরেটো স্কুলে চলে আসেন। এইভাবে ১৭ বছর কেটে যায়। এই সময় মতিঝিল বস্তির মানুষদের দুঃখ দুর্দশা মাদারের হৃদয় স্পর্শ করে। তা ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধােত্তর পরিস্থিতি, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, দেশ বিভাগ প্রভৃতি মাদারকে বিচলিত করে। এ কারণেই ১৯৫২ সালে কলকাতার কালিঘাট অঞ্চলে দরিদ্র সেবার জন্য হোেম খােলেন—যার নাম হয় ‘নির্মল হৃদয়। হত দরিদ্র ও দুরারােগ্য মানুষেরা এখানে আশ্রয় পেত। এই সময়ই টিটাগড়ে কুষ্ঠ রােগীদের জন্য একটি আশ্রম খুলেছিলেন। ভারতের বাইরে প্রথম আশ্রম খােলেন ভেনিজুয়েলাতে। এরপর ১৯৭১ সালে মিশনারি কাজকর্মের জন্য নিউইয়র্ক শহরে একটা কেন্দ্র খােলেন। এখন মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রায় সাড়ে চার হাজার সন্ন্যাসিনী এবং লক্ষ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করে চলেছেন। ১৯৯৭-এর ৪ সেপ্টেম্বর মাদার টেরিজার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরও তার কাজ সারা পৃথিবীতে সমান গতিতে চলেছে।
স্বীকৃতি ও পুরস্কার : মাদার টেরিজা ১৯৭৯ সালে শান্তির জন্য নােবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এই পুরস্কারের অর্থ তিনি আর্তের সেবায় দান করেন। নােবেল ছাড়াও ১৯৬২তে পদ্মশ্রী, ১৯৭২তে নেহরু পুরস্কার, ১৯৮০তে ভারতরত্ন উপাধি এবং বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম উপাধি লাভ করেন। এ ছাড়া ম্যানিলা থেকে ম্যাগসাইসাই ও ভ্যাটিকান সিটি থেকে ২৩তম পােপ জন পুরস্কার পান।
চরিত্র বৈশিষ্ট্য : মাদার টেরিজার কাছে জীব সেবাই ছিল শিব সেবা। তার কাছে ‘Poor body is the temple of living God' রূপে প্রতিভাত হয়েছিল। তিনি ধর্মে ক্যাথলিক হলেও জাতি-ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার অন্তরের মূল কথাটি হল মাতৃত্ব। মাতৃ হৃদয় নিয়ে তিনি দুঃখ নিপীড়িত লাঞ্ছিত বঞ্চিতদের প্রতি তাকিয়েছেন—পম স্নেহে তাদের কোলে টেনে নিয়েছেন। সেবা, ভালােবাসা দিয়ে আর্তপীড়িতকে সুস্থ করে তুলেছেন। | তাঁর মতাে শিশুসুলভ সরলতা খুব কমই দেখা যায়। মাদার টেরিজা ‘পুষ্পের মতাে নিজের জীবনকে অপরের সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন। অনাথ, আতুর, দুঃখ, রােগগ্রস্ত মানুষকে নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেছেন তিনি।
উপসংহার : মাদার টেরিজা বিশ্বে সেবার প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত। বিশ্বব্যাপী যে সব প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা সবই বিশ্বব্যাপী মানুষের দানেই। যেখানে স্বার্থের সংঘাত, | বিদ্বেষ ও হানাহানি সেখানে মানুষের হৃদয়ই পারে এই বর্তমান হতাশাময় জগৎ থেকে মুক্তি দিতে। মাদার টেরিজা ভালােবাসা, প্রেম, প্রীতি ও সেবার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে আপন করে | নিতে পেরেছিলেন। তারই জন্মের শতবর্ষে মাদার সৃষ্ট পথই আমাদের পথ হােক—পাথেয় | হােক তার ভালােবাসা।
0 Comments