২৮ এপ্রিল, ২০১৯ ১২:০৩

রাজশাহীতে প্রেমিক যুগল হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহীতে প্রেমিক যুগল হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট
রাজশাহীর হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালে চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের মামলায় চার শিক্ষার্থী ও হোটেলের দুই কর্মচারীকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। রবিবার দুপুরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মহিদুল ইসলাম রাজশাহীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্রটি জমা দেন। 
 
অভিযুক্তরা হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ (২১), রাজশাহী কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বোরহান কবীর ওরফে উৎস (২২), একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আল-আমিন (২০) ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ভর্তি প্রার্থী আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০) এবং নাইস হোটেলের বয় নয়ন (৩২) ও বখতিয়ার (৩২)। এদের মধ্যে আহসান হাবিব, বোরহান ও নয়ন এরই মধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা সবাই জামিনে আছেন। তবে হোটেল বয়রা গ্রেফতারের পর থেকে কারাগারে।
 
২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল নগরীর সাহেব বাজার এলাকার হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের ৩০৩ নম্বর কক্ষে প্রেমিক যুগলকে হত্যা করা হয়। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমানকে। আর তার প্রেমিকা সুমাইয়া নাসরিনকে হত্যা করা হয়েছিল ধর্ষণের পর বালিশ চাপা দিয়ে।
 
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, সুপরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় অভিজাত আবাসিক হোটেল কক্ষের মধ্যে দু’জনকে খুন করা হয়েছিল। ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল ‘সনি টিভি’র ক্রাইম পেট্রোল দেখে খুনের পর স্বাভাবিক থাকার এই কৌশল রপ্ত করেছিল তারা। ভেবেছিল তাদের চাতুরতা কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর পুলিশের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিমের ফাঁদে ধরা পড়ে তারা। এরপরই বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক সব তথ্য।
 
রাজশাহী পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম চার্জশিট দাখিলের জন্য গত ১৫ এপ্রিল রাজশাহীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া চার্জশিট দাখিলের জন্য সময় নেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী রবিবার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় আদালতে আলাদাভাবে দুইটি চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। একটি সুমাইয়া নাসরিনকে ধর্ষণের পর বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা এবং দ্বিতীয়টি মিজানুরকে হত্যা। দুই মামলাতেই ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
 
প্রথমে এ ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দুই হোটেল বয়কে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে দু’জন আগে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালতে জবানবন্দি দেন নয়ন। এর আগে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে বোয়ালিয়া থানা পুলিশ। তদন্ত করে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে পুুলিশ বলেছিল সুমাইয়াকে খুন করে মিজানুর আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু মরদেহ উদ্ধারের সময় মিজানুরের দুই হাত পেছন দিকে বাঁধা ছিল। হাত বাঁধা অবস্থায় কোনো লোক তো ফ্যানের সঙ্গে অন্যকে ঝুলাতে পারবে না। তদন্তে এই ক্রুটির কথা উল্লেখ করে আদালত পিবিআইয়ের কাছে মামলাটি তদন্তের জন্য পাঠায়। পরে পিবিআই তদন্ত শুরু করলে বেরিয়ে আসে মূল রহস্য। দেড় বছর পর ধরা পড়ে এ ঘটনায় জড়িত চার তরুণ। 
 
পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এটি একটি ‘ক্লুলেস’ হত্যাকাণ্ড ছিল। তবে ঘটনার তদন্তে থানা পুলিশের গাফিলতিও ছিল। তাছাড়া ময়না তদন্তের প্রতিবেদন এবং ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলেও যথেষ্ট ক্রুটি ছিল। থানা পুলিশ তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছিল, সুমাইয়াকে মাথায় আঘাত করেছিলেন মিজানুর। এরপর মিজানুর বালিশ চাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেন। আর সুমাইয়াকে শ্বাসরোধ করে হত্যার আগে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করা হয়েছে। এমনকি ডিএনএ টেস্টেও সুমাইয়ার শরীরে শুধুমাত্র মিজানুরের ডিএনএ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এছাড়া মিজানুরের মরদেহের ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে এটাকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পিবিআইয়ের তদন্তে আসল রহস্য বেরিয়ে আসে। 
 
নিহত যুবক মিজানুর রহমান ও রনির একটি ফোনকলের সূত্র ধরে পিবিআই শনাক্ত করে এক এক করে চারজনকে গ্রেফতারও করে। পিবিআই কর্মকর্তারা ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর আহসান হাবিবকে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন রাজশাহীর দুটি ছাত্রাবাস থেকে বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের তথ্য মতে দুই হোটেল বয়কে গ্রেফতার করা হয়। 
 
গ্রেফতারের পর তারা জানায়, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এর প্রতিশোধ নিতে চার বন্ধু মিলে ওই তরুণীকে ধর্ষণের পর তার প্রেমিককেও হত্যা করা হয়। এ কাজে তাদের হোটেল বয়রা সহায়তা করেন। সনি টিভির ‘ক্রাইম পেট্রোল’ সিরিয়াল দেখে তারা খুনের পর স্বাভাবিক থাকার কৌশল রপ্ত করেছিল। এতে তারা প্রথম দিকে সফলও হয়েছিল। খুনের পর দেড় বছর ধরে এলাকাতেই অবস্থান করে বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। 
 
মামলার চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারা বলেছে, নাইস হোটেলের ওই কক্ষে মিজানুরকে প্রথমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর তারা সুমাইয়াকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে। কিন্তু পুলিশের মেয়ে বলে ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে তারা তাকেও মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। পরে কৌশলে কক্ষে তালা দিয়ে ভেতরের একটি ফাঁক দিয়ে পালিয়ে যায়।
 
২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল রাজশাহীর হোটেল নাইসের ৩০৩ নম্বর কক্ষ থেকে ওই দুই তরুণ-তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে নিহত মিজানুরের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার বাবা উমেদ আলী একজন কৃষক। আর সুমাইয়ার পরিবার থাকেন বগুড়ায়। তিন বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে সুমাইয়া দ্বিতীয়। তার বাবা আবদুল করিম পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই)। ঘটনার পর তিনি বাদী হয়েই বোয়ালিয়া থানায় মামলাটি করেছিলেন।
 
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর